দীপক দেবনাথের অভিজ্ঞ হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হচ্ছে মনোমুগ্ধকর প্রতিমা, আর সেই শিল্পের উত্তরাধিকার তুলে নিচ্ছে মাত্র ১২ বছরের ছেলে—পূজোর আবহে যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে শিল্প ও সংস্কৃতির সেতুবন্ধন
তেলিয়ামুড়া প্রতিনিধি: বাঙালির প্রাণের উৎসব, দুর্গাপূজা—আর মাত্র হাতে গোনা কয়েকদিন বাকি। চারপাশে শুরু হয়ে গেছে সাজ সাজ রব। কোথাও চলছে প্যান্ডেল তৈরির তোড়জোড়, কোথাও আবার প্রতিমা নির্মাণের কাজে ব্যস্ত শিল্পীদের দিনরাত এক করে ফেলা। এমনই এক চিত্র ধরা পড়ল তেলিয়ামুড়ার নেতাজীনগরে। যেখানে শিল্পের প্রতিটি ছোঁয়ায় ফুটে উঠছে মাটি আর মানুষের ভালোবাসার গল্প।
স্থানীয় বাসিন্দা দীপক দেবনাথ, পেশায় একজন মৃৎশিল্পী, টানা ২২ বছর ধরে নিপুণতার সঙ্গে দুর্গা প্রতিমা তৈরি করে আসছেন। তার হাতের ছোঁয়ায় প্রাণ পায় মাটির প্রতিমা—যা শুধু দর্শনার্থীদেরই নয়, পূজা উদ্যোক্তাদের মনও দখল করে নিচ্ছে। প্রতিটি প্রতিমায় যেন ফুটে ওঠে দেবী দুর্গার ঐশ্বরিক সৌন্দর্য, আর শিল্পীর নিখুঁত কারুকার্য।

এবছরও ব্যতিক্রম নয়। কোমর বেঁধে কাজে নেমেছেন দীপকবাবু। তার সঙ্গে প্রতিনিয়ত কাজ করছেন আরও ২-৩ জন সহকারী মৃৎশিল্পী। তবে এবারের দুর্গোৎসব যেন তার কাছে আরও বিশেষ এক কারণে—কারণ এবার বাবার পাশে দাঁড়িয়েছে তারই মাত্র ১২ বছরের ছেলে, দেবজিৎ দেবনাথ। শিশু বয়সেই শিল্পচর্চার এমন মুগ্ধতা নজর কাড়ছে সবার।
দেবজিৎ বর্তমানে তেলিয়ামুড়া ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। কিন্তু পড়াশোনার পাশাপাশি সে বাবার কাজকেই মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছে। এখন প্রায় প্রতিদিনই স্কুল থেকে ফিরে মাটির খোল, কাঠামো, খড়ের ছাঁচ আর তুলির ঘ্রাণে কাটছে তার সময়। বাবার কাছ থেকেই সে শিখছে মৃৎশিল্পের খুঁটিনাটি, মাটির ভাষা বোঝার শিল্প।
শিল্পী ও উত্তরাধিকার: মাটি দিয়ে গড়া এক পারিবারিক গল্প
দীপক দেবনাথ জানান, “আমি গত ২২ বছর ধরে এই কাজ করছি। একসময় ছোট পরিসরে শুরু করেছিলাম, এখন অনেক ক্লাব, মণ্ডপ থেকে অর্ডার আসে। এবছর চাহিদা অনেক বেশি। যদিও কাঁচামালের দাম একটু বেড়েছে, তবুও আশা করছি লাভের মুখ দেখতে পারব।”
তিনি আরও বলেন, “শিল্পের প্রতি দেবজিতের আগ্রহ দেখে খুব ভালো লাগে। ওকে জোর করিনি, নিজেই এসে শিখতে চাইছে। এটা দেখে মনে হয়, আমার এই শিল্প হয়তো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বেঁচে থাকবে।”
দর্শনার্থীদের মুখেও প্রশংসা
দীপকের প্রতিমা দেখতে ইতিমধ্যেই এলাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসতে শুরু করেছেন। কেউ বলছেন, “তার কাজ নিখুঁত, চোখের ভাষায় মূর্তি কথা বলে।” আবার কেউ বলছেন, “এমন শিল্পী এখন আর খুব বেশি দেখা যায় না।”
পাশাপাশি, দেবজিতের শিল্পচর্চা দেখে অনেকেই উচ্ছ্বসিত। তারা বলছেন, “এই বয়সে এমন আগ্রহ সত্যিই প্রশংসনীয়। বাবা-ছেলের এই যুগলবন্দি যেন দুর্গোৎসবের আনন্দকে দ্বিগুণ করে তুলেছে।”
উপসংহার: ঐতিহ্যের মাটিতে গাঁথা ভবিষ্যতের বীজ
তেলিয়ামুড়ার এই একটুকরো শিল্পজগত যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয়—শিল্প শুধু রুটি-রুজির মাধ্যম নয়, এটি একটি জীবন্ত ঐতিহ্য, যা ভালোবাসা ও নিষ্ঠায় গড়ে ওঠে। দীপক দেবনাথ ও তার ছেলে দেবজিৎ শুধু মাটি নয়, গড়ে তুলছেন এক অমূল্য উত্তরাধিকার।
প্রজন্মান্তরে এই শিল্প হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে তেলিয়ামুড়ার সাংস্কৃতিক পরিচয় আরও সমৃদ্ধ হবে—এমনই প্রত্যাশা স্থানীয় মানুষ ও শিল্পমোদীদের।








