চিকিৎসা পরিষেবা যখন সমাজের প্রান্তিক মানুষের কাছে সহজলভ্য হয়, তখন তা কেবল একটি সাফল্য নয়, মানবিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। খোয়াই জেলা হাসপাতাল সম্প্রতি তেমনই এক নজিরবিহীন সাফল্যের সাক্ষী হলো। আয়ুষ্মান ভারত কার্ডের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে একজন দিনমজুরের নাবালিকা কন্যার পায়ের জটিল অপারেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে, যা প্রমাণ করে যে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা পেলে জীবন বাঁচানো সম্ভব।
খোয়াই, ত্রিপুরাঃ গত ২৪ আগস্ট, কল্যাণপুর আর-এস পাড়ার রণ কিশোর দেববর্মার নাবালিকা কন্যা সীমা দেববর্মা এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনার শিকার হয়। এই দুর্ঘটনায় তার ডান পা মারাত্মকভাবে ভেঙে যায়, যা তার পরিবারকে গভীর দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয়। পরদিন, তাকে দ্রুত খোয়াই জেলা হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। হাসপাতালের চিকিৎসকরা তার অবস্থা পর্যালোচনা করে তাৎক্ষণিকভাবে অপারেশনের পরামর্শ দেন। কিন্তু রোগীর পরিবার, হয়তো উন্নত চিকিৎসার আশায় বা অন্য কোনো কারণে, সীমা দেববর্মাকে নিয়ে চলে যায় জিবি হাসপাতালে।
জিবি থেকে ঝাড়ফুঁক, অতঃপর অবনতি:
জিবি হাসপাতালের চিকিৎসকরাও সীমা দেববর্মার পায়ের অপারেশনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে, রোগীর অভিভাবকরা সেখান থেকেও চলে আসেন এবং আধুনিক চিকিৎসার পরিবর্তে গ্রামের ঝাড়ফুঁক দেওয়া ডাক্তারের কাছে যান। দুর্ভাগ্যবশত, এই লোকালয় চিকিৎসার ফলে সীমার অবস্থার উন্নতি তো হয়ইনি, বরং তা আরও অবনতির দিকে যেতে থাকে। অবস্থার চরম অবনতি হওয়ায়, নিরূপায় হয়ে পরিবার আবারও তাদের নাবালিকা কন্যাকে নিয়ে আসে খোয়াই জেলা হাসপাতালে।
খোয়াই হাসপাতালের মানবিক উদ্যোগ ও আয়ুষ্মান কার্ডের ম্যাজিক:
যখন সীমা দেববর্মা দ্বিতীয়বারের মতো খোয়াই জেলা হাসপাতালে আসে, তখন তার পরিবার এক নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় – আর্থিক সংকট। দিনমজুর রণ কিশোর দেববর্মার পক্ষে এত বড় অপারেশনের খরচ বহন করা অসম্ভব ছিল। তাদের কাছে আয়ুষ্মান ভারত কার্ডও ছিল না, যা এমন জরুরি পরিস্থিতিতে তাদের সবচেয়ে বড় সহায় হতে পারতো।
কিন্তু খোয়াই জেলা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই পরিস্থিতিতে এক অসাধারণ মানবিক উদ্যোগ গ্রহণ করে। হাসপাতালের চিকিৎসকরা ও কর্মীরা দ্রুততার সাথে রোগীর পরিবারের জন্য আয়ুষ্মান কার্ড তৈরি করার ব্যবস্থা করেন। তড়িঘড়ি সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আয়ুষ্মান কার্ডের সুবিধা নিশ্চিত করা হয় এবং অপারেশনের সকল প্রস্তুতি শুরু হয়। এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে সমাজের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা এবং মানবিকতার এক উজ্জ্বল প্রমাণ।
সফল জটিল অপারেশন:
আজ, নাবালিকা কন্যা সীমা দেববর্মার পায়ের সেই জটিল অপারেশনটি সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করা হয়। এই গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রোপচারটি পরিচালনা করেন হাসপাতালের অস্থি রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডাঃ অমন দেববর্মা, ডাঃ বিশ্বজিৎ দেববর্মা সহ অন্যান্য অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা।
অপারেশন শেষে চিকিৎসক ডাঃ অমন দেববর্মা সাংবাদিকদের জানান, “নাবালিকা কন্যাটির ডান পায়ের উরুতে একটি বড় অপারেশন সম্পন্ন করা হয়েছে। আমরা সেখানে সফলভাবে প্লেট স্থাপন করেছি। অপারেশনটি অত্যন্ত জটিল ছিল, কিন্তু আমাদের দল সফলভাবে তা সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে।” তিনি আরও নিশ্চিত করেন যে, “অপারেশনের সমস্ত খরচ আয়ুষ্মান কার্ড থেকে মেটানো হয়েছে, ফলে রোগীর পরিবারকে কোনো আর্থিক দুশ্চিন্তার সম্মুখীন হতে হয়নি।”
সীমা দেববর্মার সফল অপারেশন তার পরিবারে স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছে। তারা খোয়াই জেলা হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মীদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করলো যে, সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা, বিশেষ করে আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পের মতো উদ্যোগগুলো, সমাজের দুর্বল অংশের মানুষের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। খোয়াই জেলা হাসপাতালের এই সাফল্য শুধু একটি জীবনের রক্ষা নয়, বরং চিকিৎসা ক্ষেত্রে তাদের সক্ষমতা এবং মানবিকতার এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।








